৫ই জুন, ছিল বিশ্ব
পরিবেশ দিবস। এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদযাপনের
আয়োজক দেশ হল দক্ষিন আমেরিকার দেশ কলোম্বিয়া। আর এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের থিম
বা মূল ভাবনা হল জীব-বৈচিত্র (Biodiversity)। এই জীববৈচিত্র এর ভৌগোলিক অবস্থান জনিত বিভিন্নতা একটি আশ্চর্যের বিষয়। জীব বৈচিত্র ও বাস্তুতন্ত্র একে অপরের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের বাস্তুতন্ত্র আছে। এই বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে যে যোগসূত্র রয়েছে সেটিই পৃথিবীকে বেঁচে থাকার রসদ জুগিয়ে চলেছে।
জীব বৈচিত্র কি ভাবে পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে?
আমরা জানি পৃথিবী তার অক্ষের ওপর ২৩.৫° হেলে ঘুরে চলেছে। এর ফলে সূর্য রস্মির পতনের হার পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে সমান হয়না। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে গ্রীষ্মকাল, শীতকাল ও অন্যান্য কালের ব্যাপ্তি আলাদা হয় যা ওই অঞ্চলের উষ্ণতা, আর্দ্রতা , ঠাণ্ডা প্রভৃতি আবহাওয়া সম্পর্কিত বিষয় গুলোকে প্রভাবিত করে। এই বিভিন্ন বিষয় গুলিই কোনও অঞ্চলের জীব-বৈচিত্র এর তারতম্যের ভৌগোলিক কারণ। বাস্তুতন্ত্রে জীববৈচিত্র্য হটস্পট (Biodiversity Hotspot) বলতে এমন একটি অঞ্চলকে বোঝায় যেখানে বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর ব্যতিক্রমী ঘনত্ব রয়েছে। এই হটস্পট গুলিতে বিশ্বের প্রায় ৬০% উদ্ভিদ, পাখি, স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ, উভচর বর্তমান। পৃথিবীর উপরিতলের বক্রতা এবং ঘূর্ণনের আরও একটি প্রভাব রয়েছে জল চক্রের ওপরে যা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে আলাদাভাবে জল বিতরণ করে। এর ফলেই পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টি ও তুষারপাতের তারতম্য ঘটে যা জীব-বৈচিত্র এর তারতম্যের আরও একটি অন্যতম ভৌগোলিক কারণ।
স্থলজ জীবাঞ্চল বা বায়োম
বায়োম (Biome) বা বাস্তুসংস্থানিক অঞ্চল হল একই রকম জলবায়ু, পরিবেশ, প্রানী ও উদ্ভিদ সম্বলিত অঞ্চল। এই এলাকা গুলিকে একই বাস্তুতন্ত্রে একত্রীভূত করে এক একটি জীবাঞ্চল হিসেবে ভাগ করেছেন। পৃথিবীতে প্রায় ১৫০ টি এইরকম জীবাঞ্চল বর্তমান, এর মধ্যে মূল চারটি হলঃ বনাঞ্চল, মরুভূমি অঞ্চল, তৃণভূমি ও সাভানা অঞ্চল এবং তুন্দ্রা অঞ্চল।
বনাঞ্চল
বনাঞ্চল বা জঙ্গল বলতেই আমাদের চোখের সামনে যেটা ভেসে ওঠে সেটি হল সবুজ, ছোট, বড়
বহু গাছের সমাবেশ। পৃথিবীর সমগ্র ভূভাগের প্রায় এক তৃতীয়াংশ বনভূমি দ্বারা অধিকৃত
এবং পৃথিবীর সমগ্র সজীব উপাদানের প্রায় ৭০% কার্বন এই বনাঞ্চলের মধ্যে সংরক্ষিত
রয়েছে। এছাড়াও জঙ্গল বা বনভূমির অন্যতম প্রধান উপযোগিতা হল এরা পৃথিবীর ফুস্ফুসের
কাজ করে যা পৃথিবীর কার্বন ডাই অক্সাইড কে নিয়ে অক্সিজেন হিসেবে ফেরত দেয়। বনাঞ্চল
মুলত তিন ধরনের হয়ে থাকেঃ ক্রান্তীয় বা গ্রীষ্মপ্রধান (Tropical), নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলিয় (Temperate), উত্তুরে (Boreal)।
পৃথিবীতে যে
কটি জীবাঞ্চল বর্তমান তার মধ্যে ক্রান্তীয় বনভূমিতে জীব বৈচিত্র সব থেকে বেশী। এই
ক্রান্তীয় বনাঞ্চল বিষুব অঞ্চলের খুব কাছে হওয়ার কারনে দিনে কম বেশী প্রায় ১২
ঘণ্টা দিবালোকে থাকে। এখানে অন্যান্য জীবাঞ্চল অপেক্ষা অনেক বেশী বৃষ্টিপাত হয়ে
থাকে। তাছাড়া এখানে গড় তাপমাত্রা কম বেশী
২০-২৫° সেন্টিগ্রেড
এর মধ্যে থাকে। মুলত এই তিনটি উপযোগী ভৌগলিক পরিবেশ
থাকায় এখানে ঘন বনভূমি সৃষ্ঠির কারণ। এই জীবাঞ্চলে
অন্যতম প্রধান সমস্যা হল বন-নিধন বা Deforestation. এই অঞ্চলের অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদ
টিক, মেহগিনি প্রভৃতি গাছ ঘরবাড়ি আসবাবপত্র
তৈরির কাজে লাগে তাই যথেচ্ছাচারে এই সব গাছ কাটা হয়। তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রে বনভূমি কেটে আঁখ, তাল প্রভৃতি গাছের চাষ করা হয় যেগুলি থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়া যায়।
ক্রান্তীয় বনাঞ্চল (সংগৃহীত ছবি) |
নাতিশীতোষ্ণ বনাঞ্চলে মুলত পর্ণমোচী গাছের সমাবেশ লক্ষ্য করা যায় যাদের শরৎকাল
থেকে পাতা ঝরতে শুরু করে। ৩০°-৪৫° উত্তর
অক্ষাংশ এবং ৩০°-৪৫° দক্ষিণ অক্ষাংশ এর মাঝে এই
পর্ণমোচী বৃক্ষের জঙ্গল দেখা যায়। এই অক্ষাংশ অঞ্চলে সারা বছরে প্রায় ৭৫-১৫০ সেমি
বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। ক্রান্তীয় বনভূমির মত এই বনভূমি অঞ্চলেরও মূল বিপদ হল
বন-নিধন।
নাতিশীতোষ্ণ বনাঞ্চল (সংগৃহীত ছবি) |
Boreal বা উত্তুরে বনাঞ্চলের অন্যতম বিশেষত্ব হল সরলবর্গীয় শাঙ্কবাকার উদ্ভিদের
উপস্থিতি। এই বনাঞ্চল তাইগা নামেও পরিচিত। ৫০-৬০° উত্তর
অক্ষাংশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এই বনাঞ্চল দেখা যায়। এই অঞ্চলের জলবায়ুর
বিশেষত্ত্ব হল এখানে গ্রীষ্মকালের দৈর্ঘ্য অপেক্ষাকৃত কম ও তাপমাত্রার পারদ
গরমকালে বিশেষ উর্ধ্মুখী হয়না। তবে শীতকালের ব্যাপ্তি অনেকটা ও বছরে প্রায় ৪০-১০০
সেমি এর মত তুষারপাত হয়ে থাকে। তবে বর্তমানে উষ্ণায়নের ফলে এশিয়া মহাদেশের রাশিয়া
ও উত্তর আমেরিকার এই বনভূমি সংকট জনক পরিস্থিতির সামনে। তুষারপাতের পরিমান অনেকটাই
হ্রাস পেয়েছে। ফলে এই বনভুমির মাটিতে তুষার আচ্ছাদনের সময় কাল কমে যাচ্ছে যা
মাউন্টেন পাইন নামক এক ধরনের পোকার বংশ বিস্তারের অনুকুল পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে।
যা এই অঞ্চলের গাছপালা নষ্ট করছে এবং এই অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রের খাদ্যজালের (Food Web) ওপর বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে।
মাউন্টেন পাইন পোকা (সংগৃহীত ছবি) |
উত্তুরে বনাঞ্চল (সংগৃহীত ছবি) |
মরুভূমি
ভূপৃষ্ঠে যে সকল অঞ্চলে বাৎসরিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমান ৫০সেমি র কম সেই অঞ্চলে
মরুভূমির সৃষ্টি হয়েছে। পৃথিবী পৃষ্ঠের পাঁচ ভাগের এক ভাগ হল মরুভূমি এবং এই অঞ্চল হল পৃথিবীর শুষ্কতম অঞ্চল যার ফলে এই অঞ্চলে জীব-বৈচিত্র সব থেকে কম। সাধারণত ৩০° উত্তর ও ৩০° দক্ষিণ অক্ষাংশ বরাবর
মুরুভূমিগুলির অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। তবে অন্য অক্ষাংশেও মরুভুমি দেখা যায় তবে
তাদের সৃষ্টির কারণ আলাদা। সুউচ্চ পর্বতমালার বিপরীত ঢালে বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলেও
মরুভুমির সৃষ্টি হয়ে থাকে। সিয়েরা নেভেদা পর্বতের গ্রেট বেসিন মরুভুমি, আন্দিজ পর্বতের
বিপরীত ঢালে প্যাটাগোনিয়ার মরুভুমি এই জাতীয় মরুভূমির উদাহরণ। দক্ষিণ আমেরিকা ও
আফ্রিকার দক্ষিণপশ্চিম সমুদ্রতট অঞ্চলে মরুভুমি দেখা যায়, যেগুলি যথাক্রমে আটাকামা
মরুভুমি ও নামিব মরুভুমি নামে পরিচিত। এগুলি সৃষ্ট হবার কারণ আবার একটু আলাদা।
এখানে গভীর শীতল সমুদ্রস্রোত সমুদ্র সংলগ্ন বায়ুমণ্ডলকে শীতল করে তোলে। ফলে এই
বায়ু ভূভাগে আসার পূর্বেই তার সমস্ত আর্দ্রতা বৃষ্টি রুপে সমুদ্রপৃষ্ঠে ঝরিয়ে দেয়। আবার মেরু অঞ্চলিয় মরুভূমি মুলত সুমেরু
ও কুমেরু অঞ্চলে দেখা যায়। উত্তর গ্রিনল্যান্ড ও আন্টারটিকার বরফ বিহীন অঞ্চলে এই
ধরনের মেরু মরুভূমি দেখা যায়।
গ্রেট বেসিন মরুভুমি (সংগৃহীত ছবি) প্যাটাগোনিয়ার মরুভুমি (সংগৃহীত ছবি) আটাকামা মরুভুমি (সংগৃহীত ছবি) |
নামিব মরুভুমি (সংগৃহীত ছবি)
প্রত্যেক মরু অঞ্চলেই তার বিশেষ কিছু উদ্ভিদ, মেরুদণ্ডী ও অমেরুদণ্ডী প্রাণী
লক্ষ্য করা যায় যারা নিজেদের ওই প্রতিকূল পরিবেশে অভিযোজিত করার জন্য শারীরিক
গঠনের বিশেষ কিছু পরিবর্তন ঘটায়। যেমন মরু অঞ্চলিয় উদ্ভিদের অন্যতম বৈশিষ্ঠ্য হল
বাষ্পমোচন হ্রাস করার জন্য এই উদ্ভিদের পাতা কণ্টকে রুপান্তরিত হয়। আবার উত্তর
আমেরিকার দক্ষিণ-পশ্চিমের সোনোরান মরুভূমিতে এক ধরনের শিয়াল দেখা যায় যাদের কানের
বাইরের অংশ অনেক প্রসারিত যার থেকে জল বাষ্পীভূত হয়ে দেহকে ঠাণ্ডা রাখে।
সোনোরান মরুভূমির কিট শেয়াল (সংগৃহীত ছবি) |
মরুভূমি অঞ্চলের গাছপালা (সংগৃহীত ছবি)
সাভানা ও তৃণভূমি অঞ্চল
সাভানা ও তৃণভূমি অঞ্চলের বৈশিষ্ঠ্য হল বহু বর্ষজীবী ঘাস ও কাষ্ঠ বিহীন গাছ গাছড়ার
উপস্থিতি। যদিও সাভানা অঞ্চলে বাৎসরিক পর্যাপ্ত
পরিমানে বৃষ্টিপাত হয় তাই কিছু ছড়ানো ছিটানো বড় গাছ ও এই অঞ্চলে দেখা যায় কিন্তু তৃণভূমিতে
এই বৃষ্টিপাতের পরিমান পর্যাপ্ত নয়। তৃণভূমি
মুলত নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার অন্তর্গত হওয়ায় গ্রীষ্মকালে যেমন গরম পরে শীতকালেও তেমন
তুষারপাত ঘটে। এই সকল উদ্ভিজ্জ বৈশিষ্ঠ্যর জন্য এই
অঞ্চলে তৃণভোজী প্রাণীর উপস্থিতি চোখে পরার মত। যেমন আফ্রিকার সভানা অঞ্চলে ওয়াইল্ড
বিস্ট হরিণ বা উত্তর আমেরিকার সমভূমি অঞ্চলে বাইসন এই জীবঞ্চলের বৈশিষ্ঠ্য। আফ্রিকার এই ওয়াইল্ড বিস্ট, জেব্রা বা গ্যাজেল এর মত তৃণভোজী প্রাণীরা
বছরের একটা সময়ে সাভানার এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে পাড়ি দেয় আর্দ্রতার জন্য। কিন্তু ক্রমবর্ধমান নগরায়নের ফলে
এদের গতিপথ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে যার ফলে এদের পরিবেশগত অবস্থান (Ecological Niche) ক্ষতির সন্মুখিন হচ্ছে। সাভানা অঞ্চলের ঘাসের আর একটা
উল্লেখ্য বৈশিষ্ঠ্য হল এদের শিকড় অনেক দীর্ঘ হয় আর এরা তাড়াতাড়ি বেড়ে ওঠে তাই এই অঞ্চলের
মাটি জৈব কার্বনের ভাণ্ডার হিসেবে কাজ করে। পৃথিবীর এই রকম অধিকাংশ তৃণভূমি
পরবর্তীকালে চাষের জমিতে পরিণত করা হয়েছে যার ফলে সেখানকার মাটির জৈবনিক গুনাগুন
নষ্ট হয়েছে ও ওই অঞ্চলের জীব বৈচিত্র হ্রাস পেয়েছে।
সাভানা ও তৃণভূমি অঞ্চল (সংগৃহীত ছবি) |
তুন্দ্রা অঞ্চল
তুন্দ্রা হল পৃথিবীতে শীতলতম জীবাঞ্চল যেখানে শীতকালীন গড় তাপমাত্রা -৩৪° সেন্টিগ্রেড ও গ্রীষ্মকালীন গড় তাপমাত্রা
৩-১২° সেন্টিগ্রেডের
মধ্যে থাকে। এখানে গ্রীষ্মকাল ৫০-৬০ দিনের মত স্থায়ী হয়। এই স্বল্প সময়েই এখানে দলে
দলে পরিযায়ী পাখি ও বল্গা হরিণের উপস্থিতি চোখে পরে। এই অঞ্চলের মাটিও জৈব খনিজে ভরপুর
যা সব সময়ে হিমায়িত (Frozen) অবস্থায় থাকে। একে পারমাফ্রস্ট (Permafrost) বলে। তবে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই পারমাফ্রস্ট এর স্তর ক্রমশ গলতে শুরু করেছে ফলে বিভিন্ন জৈবিক উপাদান সমূহ পরিবেশে নির্গত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে মিথেন, যা এইভাবে পরিবেশে নির্গত হয়ে গ্রীন হাউস এফেক্ট এর সৃষ্টি করছে।
তুন্দ্রা অঞ্চল (সংগৃহীত ছবি) |
জলজ বাস্তুতন্ত্র
জীবমণ্ডলের সমগ্র অঞ্চলের মধ্যে জল সবচেয়ে বেশী অঞ্চল অধিকার করে আছে। এই জলই হল বিভিন্ন জলজ বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী উপাদান। জলজ বাস্তুতন্ত্রের জীব বৈচিত্র সবচেয়ে বেশী ও এই জলজ বাস্তুতন্ত্র মুলত দুই প্রকারের হয়ঃ পরিষ্কার স্বাদু জলের বাস্তুতন্ত্র ও লবনাক্ত বা সামুদ্রিক জলের বাস্তুতন্ত্র।
পরিষ্কার স্বাদু জলের বাস্তুতন্ত্র
স্বাদু জলের বাস্তুতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ঠ্য হল এতে লবনের ভাগ খুবই কম থাকে। মুলত
নদনদী, ভূগর্ভস্থ জল, পুকুর, হ্রদ, খাল, বিলে এই ধরনের বাস্তুতন্ত্র দেখা যায়। তবে
প্রবহমান জলের বাস্তুতন্ত্র যা লোটিক সিস্টেম (Lotic System) নামে পরিচিত তার জীব বৈশিষ্ঠ্য, স্থির
জলের বাস্তুতন্ত্র যা লেন্টিক সিস্টেম (Lentic System) নামে পরিচিত, তার জিব-বৈশিষ্ঠ্য অপেক্ষা আলাদা।
বিভিন্ন অক্ষাংশে জলবায়ুর বিভিন্নতার দরুন ভৌগোলিক কারনে স্বাদু জলের বাস্তুতন্ত্রে
জিব-বৈচিত্রের বিভিন্নতা দেখা যায়। বিষুবাঞ্চলীয় স্থলজ জীবমণ্ডলের মতই বিষুবাঞ্চলীয়
জলজ জীবমণ্ডলে বিভিন্ন প্রজাতির জীব লক্ষ্য করা যায়। মাছ ও উভচরের ক্ষেত্রে এই বৈচিত্র
সর্বাধিক। এই জীব বৈচিত্র বিষুব অঞ্চল থেকে যত উত্তর বা দক্ষিণ অক্ষাংশ বরাবর যাওয়া
যায় ততই কমতে থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় আমাজন নদীর কথা। এই নদীতে ২০০০ থেকে ৫০০০
এর বেশী প্রজাতির মাছ আছে ও এই নদী বিষুব অঞ্চল বরাবর প্রবাহিত হয়েছে। ওপর দিকে মিসিসিপি
নদী, উত্তরে ৪৫°-৩০° অক্ষাংশ বরাবর বয়ে চলেছে, তাতে সর্বাধিক
৩৭৫ রকমের প্রজাতির মাছ বর্তমান। সন্মিলিতভাবে
কমবেশি প্রায় ১৫০০০ রকম মাছের প্রজাতির মধ্যে প্রায় ৪৫% হয় স্বাদু জল বা স্বাদু ও লবন মিশ্রিত
ব্র্যাকিশ জলে (Brackish Water) পাওয়া যায় বাকি ৫৫% মাছের প্রজাতি সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের অধিবাসী। আণুবীক্ষণিক শেওলা বা মাইক্রো অ্যালগি
হল বেশীরভাগ জলজ বাস্তুতন্ত্রের উৎপাদক শ্রেণির অন্তর্গত তাই খাদ্য শৃঙ্খলের একেবারে
তলায় এদের অবস্থান।
সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র
ভূভাগের উপরিতল ক্ষয় হয়ে ক্ষয়িত লবন সমুদ্রের জলের লবনাক্ততাকে বৃদ্ধি করে। ভূভাগের চারভাগের প্রায় তিন ভাগ
সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের অধীন। সাগর, মহাসাগর ছাড়াও প্রবাল প্রাচীর, সামুদ্রিক খাঁড়ি ও এই বাস্তুতন্ত্রের
মধ্যে পরে। এদের মধ্যে সামুদ্রিক খাঁড়ি হল সমুদ্র ও নদীর সংযোগস্থল। তাই এতে সামুদ্রিক
লবনাক্ত জলের সাথে স্বাদু জলও মিশ্রিত থাকে। একে ব্রাকিশ জল (Brackish Water) বলে। সমুদ্রের উদ্ভিদ
প্ল্যাঙ্কটন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলীয় অক্সিজেনের উৎস হিসেবে কাজ করে পরিবর্তে এই উদ্ভিদ
প্ল্যাঙ্কটন বায়ুমণ্ডল হতে অধিকাংশ কার্বনডাইঅক্সাইড কে গ্রহন করে।
সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রকেও স্থলজ জীবাঞ্চলের মত
বিভিন্ন বাস্তু অঞ্চলে ভাগ করা যায়।
সামুদ্রিক খাঁড়ি বা Estuaries
নদী যখন সমুদ্রে মিলিত
হয় তখন সেই মিলনস্থলকে বলে খাঁড়ি। স্বাভাবিক ভাবে নদী ও সমুদ্রের জলের লবণ ও বিভিন্ন
পোষক পদার্থের ঘনত্ব আলাদা হয়। ফলে এই দুটি সম্পূর্ণ আলাদা জলীয় বাস্তুতন্ত্রের মিলনস্থলকে বলে ইকোটোন (Ecotone) এবং এই ইকোটোন
অঞ্চল জীববৈচিত্রে সমৃদ্ধ হয়ে থাকে। উদ্ভিদদের মধ্যে মাইক্রোফ্লোরা যেমন
শেওলা, ম্যাক্রোফ্লোরা যেমন সামুদ্রিক শৈবাল, লবনাম্বুজ (Mangrove) উদ্ভিদ (কেবলমাত্র বিষুব অঞ্চলে) খাঁড়িতে পাওয়া যায়। আর প্রানীদের মধ্যে বিভিন্ন প্রকারের সামুদ্রিক কীট, কাঁকড়া, ঝিনুক ইত্যাদি প্রধান।
সামুদ্রিক খাঁড়ি (সংগৃহীত ছবি) |
ইন্টার টাইডাল ও সাব টাইডাল অঞ্চল
সমুদ্রতটবর্তী অঞ্চল যা নদীর মোহনার থেকে দূরবর্তী সেই অঞ্চল সমূহ ইন্টার ও
সাব টাইডাল অঞ্চলের অন্তর্গত। ইন্টার টাইডাল অঞ্চল পর্যায়ক্রমে জোয়ারের সময়
জলাচ্ছন্ন থাকে আর ভাটার সময় বায়ুতে উন্মুক্ত হয়। এই বাস্তুতন্ত্রের জীবেরা
পর্যায়ক্রমিক উন্মুক্ত বায়ু ও জলাচ্ছন পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারে। মুলত ঝিনুক,
তারামাছ, সামুদ্রিক অ্যানিমোন, শৈবাল এই প্রকার বাস্তুতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত।
সাবটাইডাল অঞ্চল সমুদ্রতট থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত যা সব সময়েই জলের তলায় থাকে ও
জোয়ারের জল দ্বারা প্রভাবিত হয়। ঘন শেওলা ও সামুদ্রিক ঘাসের স্তর এই ধরনের
বাস্তুতন্ত্রে দেখা যায় যা বিভিন্ন
মাছ, চিংড়ী ও অন্যান্য সামুদ্রিক জীবের বাসস্থান।
প্রবাল স্তর অঞ্চল
পৃথিবীতে সর্বাপেক্ষা বৈচিত্রময় বাস্তুতন্ত্র এই প্রবালস্তরে অবস্থিত। এই স্তর
বিভিন্ন মহাদেশের মাঝে প্রাচীর হিসেবে অবস্থিত। প্রবাল মুলত জুজ্যানথেলি (Zooxanthellae) প্রাণীজ পলিপ
(Polyps) এর মাঝে এক প্রকার অন্যোন্যজীবি (Symbiosis) সম্পর্ক। এক্ষেত্রে উভয়ে ক্যালসিয়াম
কার্বোনেট বা চুনাপাথর নির্মিত একটি কঠিন কাঠামোর মধ্যে থাকে। এই সুন্দর কাঠামো বিভিন্ন
মাছের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ক্রান্তীয় দেশ গুলির ক্ষেত্রে এই প্রবাল প্রাচীর ও সংলগ্ন
সামুদ্রিক ঘাসের স্তর ও লবনাম্বুজ উদ্ভিদ গোষ্ঠী অর্থনৈতিক ও বাস্তুসংস্থানগত দিক
থেকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীতে সর্বোচ্চ জীব বৈচিত্র সমৃদ্ধ সামুদ্রিক জীবাঞ্চল
কোরাল ত্রিভুজ নামে পরিচিত। কোরাল ত্রিভুজের অন্তর্গত বিভিন্ন অঞ্চল গুলি হলঃ
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু অংশ, প্রশান্ত মহাসাগরের বিভিন্ন অঞ্চল যেমন
ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, পাপুয়া নিউগিনি, ফিলিপাইন্স, টিমোর লেস ও সলোমন
দ্বীপপুঞ্জ। এই কোরাল ত্রিভুজ অঞ্চলে বিশ্বের সর্বাধিক প্রবাল ও সর্বাধিক প্রজাতির
মাছের উপস্থিতি লক্ষ্যনীয়। ৭৮৯ প্রকার কোরাল প্রজাতির মধ্যে প্রায় ৭৬% ও ৬০০০
কোরাল মাছ প্রজাতির মধ্যে ৩৭% এই অঞ্চলে পাওয়া যায়।
প্রবাল স্তর (সংগৃহীত ছবি) |
সামুদ্রিক অঞ্চল বা Pelagic Zone
সমুদ্রতট থেকে বহু
দূরে উন্মুক্ত জল এই অঞ্চলে অন্তর্গত। সমুদ্রের উপরিভাগ থেকে সমুদ্র গভীরে যত দূর
আলো পৌছায়, ততদূর অবধি এই অঞ্চল বিস্তৃত। এই অঞ্চলে যে সকল জীব দেখা যায় তারা সকলেই
প্ল্যাঙ্কটনের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে। তাই এদের প্ল্যাঙ্কটিভোরাস বলা হয়। এদের
উদাহরণ হল স্মেল্ট, সার্ডিন , স্যামন, তুনা, সোডফিস, সানফিস ইত্যাদি।
সার্ডিন (সংগৃহীত ছবি) |
সানফিস (সংগৃহীত ছবি)
পেলাজিক অঞ্চলের পর থেকে গভীর সমুদ্রতলে যেখানে আলো পৌছায়না, সেই অঞ্চল পর্যন্ত
বিস্তৃত। যেহেতু এখানে আলো পৌছায় না তাই এখানে স্বালোকসংশ্লেষকারী জীব এখানে থাকে না।
তা স্বত্বেও এই অঞ্চলে বিভিন্ন বৈচিত্র
যুক্ত জীব এখানে থাকে। এই অঞ্চলে উপস্থিত একটি উল্লেখযোগ্য প্রাণী হল অ্যাংলার মাছ।এদের
দেহ হতে এক ধরনের ফ্লুরোসেন্ট আলো নির্গত হয় যা এদের শিকারকে আকর্ষণ করে কাছে টেনে
আনে।
অ্যাংলার মাছ (সংগৃহীত ছবি)
তথ্যসূত্রঃ https://healingearth.ijep.net/
|
অসাধারণ লেখা। সমৃদ্ধ হলাম।
ReplyDeleteধন্যবাদ ভাই।
Delete