ভারতের পর্যটন মানচিত্রে একটি অন্যতম নাম হল পেলিং। পশ্চিম সিকিমের এই শহর শিলিগুড়ি থেকে
১৩৫ কিমি দুরত্বে ও গ্যাংটক থেকে ১১৫ কিমি দুরত্বে অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৯০৬ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত এই শহর আল্পাইন
গাছপালা দিয়ে আবৃত এবং অনেকটাই দূষণ মুক্ত। সড়কপথে এনজেপি থেকে পেলিং পৌছাতে সাড়ে
চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা সময় নেয়। এই যাত্রাপথের অনেকটা সময় জুড়ে সঙ্গী হবে সবুজ
তিস্তা। যে কবার পেলিং গেছি প্রতিবারই শীতের সময় তাই ঠাণ্ডাও পেয়েছি প্রচুর। বছরের
যে কোনও সময়েই পেলিং যাওয়া যায় তবে বর্ষাকালটা বাদ দিয়ে গেলেই ভাল। পেলিংকে
কেন্দ্র করে ঘুরে বেড়ানোর জায়গা আছে প্রচুর। তাই ভ্রমন প্রিয় বাঙ্গালির একটি প্রিয়
গন্তব্যস্থল হল পেলিং। পেলিং এ থাকার জন্য বিভিন্ন বাজেটের হোটেল আছে।
প্রথম যেবার পেলিং গেছিলাম সেবার দুপুরের দিকে হোটেলে
পৌঁছেছিলাম তুমুল বৃষ্টিকে সঙ্গী করে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছিল। নেটে দেখেছিলাম
পেলিং থেকে দেখা কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরুপ ছবি। সেটা দেখতে পাবো কিনা অনিশ্চয়তায় মন ভার
হয়ে গেছিলো। তবে হোটেলের মালিক বলেছিলেন কাল সকালে পরিষ্কার আকাশ পাবেন। বিকেলের
দিকে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেছিলো আর শীত কাকে বলে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম।
কলকাতায় ৯ ডিগ্রি মানেই বাঙালি আনন্দে আত্মহারা আর পেলিং এ সেদিন ছিল ৪ ডিগ্রি।
জমে পুরো বরফ হয়ে যাবার অবস্থা। সন্ধ্যা তখন সাড়ে ছটা কি সাতটা হবে। কয়েকজন মিলে
হোটেলের সামনে একটু ঘুরতে বেরলাম। রাস্তায় কিছু দূর এগিয়ে একটা বাঁক ঘুরতেই আমরা
সকলে মুখ হাঁ করে থমকে দাঁড়িয়ে পরলাম। দূরের পাহাড়ের গায়ে কে যেন ছোট টুনির জাল
পেতে দিয়েছে। আকাশ ভর্তি তারা যেন আকাশ ছেড়ে পাহাড়ের গায়েও ছড়িয়ে পড়েছে। তখনই আভাস পেয়েছিলাম, পেলিং নিরাশ
করবেনা। সত্যিই করেনি। পরের দিন ভোর পাঁচটা নাগাদ দলবল সমেত হোটেলের ছাদে জড়ো
হলাম। ঘড়ির কাটা এগোচ্ছে আর একটু একটু করে কাঞ্চনজঙ্ঘা চোখের সামনে পরিষ্কার
হচ্ছে। প্রথম সূর্যের আলো যখন কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায় পরল তখন আমরা সবাই সেই অপার্থিব
দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে ভাবলাম যা দেখলাম তা জন্ম জন্মাতরেও ভুলবো না। এই রকম অনেক
টুকরো টুকরো স্মৃতি পেলিং কে ঘিরে রয়েছে। সব বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে।
ভোর তখন ৫টা। হোটেলের ছাদ থেকে দেখা কাঞ্চনজঙ্ঘা। |
প্রথম সূর্যের আলো পড়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপর। |
ভাষায় ব্যাক্ত করা যায়না এই সৌন্দর্য। |
পেলিং এ বেড়াতে গিয়ে অবশ্য দর্শনীয় স্থানঃ
১. সাঙ্গা
চলিং মনেস্ট্রিঃ ১৬৯৭ খৃষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত এই মনেস্ট্রি সিকিম এর দ্বিতীয়
প্রাচীনতম মনেস্ট্রি। “Sanga Choling” এর অর্থ হল “রহস্যময় শিক্ষার দ্বীপ”। আমাদের হোটেল থেকে ৪৫ মিনিটের
হাঁটা রাস্তাতেই ছিল এই মনেস্ট্রি। আঁকা বাঁকা সর্পিল পথে বেশ খানিকটা চড়াই ভেঙ্গে
যখন এই মনেস্ট্রিতে পৌঁছেছিলাম তখন সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেছিলো এর অপরুপ নৈসর্গিক
দৃশ্য দেখে।
সাঙ্গা চোলিং মনেস্ট্রি। |
সাঙ্গা চলিং মনেস্ট্রি যাবার সেই আঁকা বাঁকা চড়াই পথ। |
সাঙ্গা চলিং মনেস্ট্রির ভিতরের দেওয়ালে অপূর্ব চিত্র। |
সাঙ্গা চোলিং মনেস্ট্রি থেকে দেখা কাঞ্চনজঙ্ঘা। |
২. পেমিয়াংসি মনেস্ট্রিঃ পেলিং থেকে এক কিলোমিটারের ও কম দুরত্বে অবস্থিত এই মনেস্ট্রি। অজস্র ধর্মীয় মূর্তি দিয়ে সজ্জিত এই মনেস্ট্রি, যেগুলি প্রাচীনতার বিচারে দুর্মূল্য। এই মনেস্ট্রির সবচেয়ে উপরের তলায় রয়েছে একটি কাঠের তৈরি সাত তলা দুর্মূল্য ভাস্কর্য যা মহাগুরু রিমপোচে র স্বর্গীয় প্রাসাদ সাংটোপালড়ি র অনুকরণে তৈরি। তিব্বতীয় চন্দ্রমাস অনুযায়ী দ্বাদশ মাসের ২৮ ও ২৯ তম দিনে (সাধারনত জানুয়ারি/ ফেব্রুরি মাসে) এখানে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের নাচের অনুষ্ঠান হয়ে থাকে যা “ছাম” নামে পরিচিত।
পেমিয়াংসি মনেস্ট্রি। |
৩. রাবদাংসি ভগ্নাবশেষঃ পেমিয়াংসি মনেস্ট্রির অনতি দুরত্বে অবস্থিত সিকিমের দ্বিতীয় রাজধানী রাবদাংসি (১৬৭০-১৮১৪)। দ্বিতীয় চোগিয়াল (প্রাচীন সিকিমে রাজাদের চোগিয়াল বলা হত) এটি নির্মাণ করেন। কিন্তু নেপালি আক্রমনের জন্য এটি পরিতক্ত হয় ও রাজধানী স্থানান্তরিত হয় তুমলুং এ। মুল রাস্তা থেকে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে প্রায় ২ কিমি চড়াই রাস্তা ভেঙ্গে এখানে পৌছাতে হয়। এখানকার চোর্তেন গুলি থেকে প্রাচীন সিকিম গন্ধ পাওয়া যায়। এখান থেকে নিচে উপত্যকার দৃশ্য অতুলনীয়। বর্তমানে এটি আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার রক্ষণাবেক্ষণের অধীনে।
রাবদাংসির ভগ্ন প্রাসাদ। |
রাবদাংসির চোর্তেন। |
৪. খেচোপারি লেকঃ প্রায় ৬৪০০ ফিট উচ্চতায় পেলিং এর
দক্ষিণ পশ্চিমে প্রায় ৩৪ কিমি দুরত্বে অবস্থিত এটি সিকিমের অন্যতম পবিত্র একটি
লেক। এটি ইচ্ছাপূরণ লেক (Wishing Lake) নামেও পরিচিত। একটি আশ্চর্যের
বিষয় হল এই লেকটির আকৃতি অনেকটা পদচিহ্নের মত ও ঘন জঙ্গলের মধ্যে থেকেও এর স্বচ্ছ জলে
পাতা ও পরে থাকতে দেখা যায়না। কথিত আছে
এর জলে পাতা পরলে সেটি পাখি তুলে নিয়ে যায়। এখান থেকে এক ঘন্টার চড়াই হাঁটলে একটি পবিত্র গুহা আছে ও আরও ঘন্টা দেড়েক এর চড়াই
তে পৌছলে পুরো লেকটির অপূর্ব দৃশ্য সকল পরিশ্রমকে নিমেষে উড়িয়ে দেয়।
খেচোপারি লেক। |
৫. কাঞ্চনজঙ্ঘা জলপ্রপাতঃ পেলিং থেকে ইওকসাম যাবার পথে প্রায় ১৫ কিমি দুরত্বে এটি অবস্থিত। প্রায় ৩০০ ফিট উচ্চতা থেকে গ্রানাইট পাথরের ওপর সশব্দে ও ধাপে ধাপে নেমে এসেছে এই জলপ্রপাত।
কাঞ্চনজঙ্ঘা ফলস। |
৬. রিম্বি জলপ্রপাতঃ খেচোপারি- ইওকসাম ট্রেক রুটে পেলিং থেকে ১২ কিমি দূরে এই জলপ্রপাত। এর কাছেই রয়েছে রিম্বি নদী। কারচেন পাওয়ার হাউজ এখানকার অন্যতম আকর্ষণ।
৭. চেঙ্গি জলপ্রপাতঃ পেলিং থেকে ডেটাম যাবার রাস্তায়
১০ কিমি দূরে এটিও একটি সুন্দর জলপ্রপাত।
৮. সিংসোর এর ঝুলন্ত সেতুঃ পেলিং থেকে উতড়ে যাবার পথে ২৫ কিমি দুরত্বে, ডেটাম থেকে ৫ আগে এটি প্রায় ২৪০ মিটার দীর্ঘ সেতু যা প্রায় ১০০০ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত। এটি সিকিমে সর্বোচ্চ ও এশিয়ার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঝুলন্ত সেতু।
সিংসোর সেতু। |
সাধারন ঠিকঠাক বাজেটের হোটেল পেলিং এ প্রচুর আছে। তবে আমি যে কবার পেলিং এ গেছি তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হোটেল হলঃ
১. Hotel Tashi Gyal Tsen ( তিন তারা হোটেল)। যোগাযোগঃ 094341 84438
২. Hotel Haven. যোগাযোগঃ 03595 258
238
Wonderful
ReplyDeleteThank you.
ReplyDelete