Friday 3 July 2020

হংসেশ্বরী মন্দির ও তার ইতিহাস


“বহু দিন ধরে, বহু ক্রোশ দূরে

বহু ব্যায় করি, বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশির বিন্দু।“
কলকাতা থেকে মাত্র ৫০ কিমি দুরত্বে হুগলী জেলার অন্যতম শহর, বাঁশবেড়িয়া। হাওড়া থেকে ব্যান্ডেল-কাটোয়া লাইনে ব্যান্ডেল থেকে ৪ কিমি দুরত্বে বাঁশবেড়িয়া স্টেশন। প্রাচীন বাংলায় এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর নগরী। এই শহর বিখ্যাত হংসেশ্বরী মন্দিরের জন্য। এই মন্দিরের সাথে জড়িয়ে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। এই মন্দির প্রতিষ্ঠা বা এর ইতিহাস জানতে গেলে আমাদের যেতে হবে বর্ধমান জেলার পাটুলি তে। প্রাচীন বাংলার একটি ছোট্ট সুখী গ্রাম ছিল পাটুলি। এই গ্রামের জমিদার ছিলেন জয়ানন্দ রায়। জমিদার জয়ানন্দের পাঁচটি ছেলে ছিল যাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিলেন রাঘব রায়। এই রাঘব রায় সম্রাট জাহাঙ্গীরের দাক্ষিন্যে “চৌধুরী” উপাধি লাভ করেন। তিনি অবশ্য এখানেই থেমে থাকেননি। পরবর্তীতে তিনি সম্রাটের থেকে “মজুমদার” উপাধি ও ২১টি পরগনার জমিদারী লাভ করেন।
এই শুরু হল রায় পরিবারের জয়যাত্রা। বৃহস্পতি তখন সপ্তমে। সেই সময় ওই অঞ্চলে বর্ধিষ্ণু পরিবার হিসেবে রায় পরিবারের প্রভাব প্রতিপত্তি সন্মান সবই তুঙ্গে ওঠে। কিন্তু বাঙালি জাতি বলে কথা ,নিজেদের মধ্যে অটুট সম্পর্ক থাকাটা অসম্ভবের নামান্তর। রাঘব রায় এর মৃত্যুর পর তার সম্পত্তি তার দুই ছেলে রামেস্বর রায় ও বাসুদেব রায়এর মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। দুই তৃতীয়াংশ পায় বড় ছেলে রামেস্বর রায় ও বাকিটুকু ছোট ছেলে বাসুদেব রায়। রামেস্বর রায় পাটুলি থেকে বেরিয়ে এসে “বংশবাটী” তে বসবাস শুরু করেন। তিনি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য সহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রায় ৩৬০ টি পরিবার নিয়ে স্থায়ীভাবে এই বংশবাটীতে নিজের জমিদারির পত্তন করেন। এই “বংশবাটী” ই বর্তমানে বাঁশবেড়িয়া নামে পরিচিত।
বাবার মত রামেস্বর রায় ও মুঘল সম্রাটের বিশ্বাসভাজন ছিলেন। তিনি লক্ষ্য করেন তার অধীনে বেশ কিছু পরগণার জমিদাররা সঠিক কর দিচ্ছেন না। তিনি নিজেই দায়িত্ব নিয়ে সঠিক পরিমান কর মুঘল সম্রাটকে পরিশোধের ব্যবস্থা করেন। তিনি রাজস্ব আদায় ব্যাবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটান ফলে মুঘল রাজকোষে রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি কমে যায়। এই ঘটনা সম্রাট অউরংজেব এর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ফলস্বরূপ রামেস্বর রাই ১৬৭৩ সালে “রাজা মশাই” উপাধিতে ভূষিত হন। ভাগ্য দেবতা এখানেই থেমে থাকেননি। পরবর্তীতে তিনি নতুন করে আরও ১২ টি পরগনা নিজের প্রশাসনিক অঞ্চলের মধ্যে পান এবং ১৬০ একর জমি নিজের বসতবাটি তৈরির জন্য মুঘল সম্রাটের থেকে উপহার পান যা ছিল সম্পূর্ণ কর মুক্ত। ক্ষুরধার প্রশাসনিক বুদ্ধি সম্পন্ন ও দয়ালু রামেস্বর রায় শিক্ষানুরাগী ছিলেন। তিনি তার অঞ্চলে অনেক সংস্কৃত টোল স্থাপন করেন ও সেগুলি সঠিক ভাবে পরিচালনার জন্য তিনি বেনারস থেকে অনেক সংস্কৃত পণ্ডিতদের নিজের কাছে নিয়ে আসেন।
তৎকালীন বাংলার একটি অন্যতম সমস্যা ছিল মারাঠা বর্গীদের আক্রমণ। রামেস্বর রায় প্রায় এক বিঘা জমির ওপরে বাঁশের জঙ্গল কেটে তাতে একটি পরিখা বেষ্টিত দুর্গ নির্মাণ করেন। সেই থেকেই এই অঞ্চল বাঁশবেড়িয়া নামে পরিচিত। তখন অবশ্য এই দুর্গ “গড়বাটী” নামে পরিচিতি পায়। এই দুর্গের প্রতিরক্ষার কাজে তিনি বিশ্বস্ত পাঠান যোদ্ধাদের নিয়োগ করেন। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই বিশ্বস্ত পাঠান যোদ্ধাদের তিনি মুঘল সম্রাটের দাক্ষিন্যে পেয়ে ছিলেন। এই পাঠান যোদ্ধাদের কিছু বংশধরেরা এখনও বাঁশবেড়িয়া অঞ্চলে আছেন।
রামেস্বর রায় ছিলেন নিষ্ঠাবান ধর্মভীরু হিন্দু। তার উপাস্য দেবতা ছিলেন ভগবান বিষ্ণু। তিনি ১৬৭৯ তে ভগবান বিষ্ণুকে সমর্পিত একটি টেরাকোটা মন্দির নির্মাণ করেন যা বর্তমানে হংসেশ্বরী মন্দির সংলগ্ন  অনন্ত বাসুদেব মন্দির নামে পরিচিত। প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্য টেরাকোটা মন্দিরের একটি ধ্রুপদী উদাহরণ হল এই মন্দির। এই মন্দির গাত্রে ব্যসল্ট পাথরে প্রাচীন বাংলায় উৎকীর্ণ লেখা মন্দিরটির সৌন্দর্য বর্ণোজ্জ্বল অতীতকে মনে করিয়ে দেয়।
অনন্ত বাসুদেব মন্দির

অনন্ত বাসুদেব মন্দির
মন্দির গাত্রে টেরাকোটার কাজ

মন্দির গাত্রে টেরাকোটার কাজ

মন্দির গাত্রে টেরাকোটার কাজ

মন্দির গাত্রে টেরাকোটার কাজ
রামেস্বর রায়ের মারা যাবার পর রায় পরিবারের জৌলুস কমতে থাকে এবং রায় পরিবারের ওপর অনেক দুর্যোগ হানা দেয়। রামেস্বর রায়ের নাতি গোবিন্দদেব রায় অকালে মারা যান। তার মৃত্যুতে জমিদারীর অধিনস্ত অনেক অঞ্চল হাতছাড়া হয়ে যায়। তাছাড়া ততদিনে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন হয়ে গেছে আর ভারতে ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রমরমা বেশ ভালই বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও সময়ের সাথে সাথে রায় পরিবারও ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আস্থাভাজন হয়ে উঠেছিল। এর ফল স্বরূপ রায় পরিবার হৃত জমিদারির কিছু অংশ ওয়ারেন হেস্টিংস ও লর্ড কর্নওয়ালিস দয়ায় ফিরে পায়। সেই সময় জমিদার ছিলেন রামেস্বর রায়ের প্রপৌত্র ও গোবিন্দদেব রায়ের পুত্র নৃসিংহদেব রায়।
রাজা নৃসিংহদেব রায়
রাজা নৃসিংহদেব রায় ছিলেন সংস্কৃত পণ্ডিত। ১৭৯২ থেকে ১৭৯৯ দীর্ঘ সময় তিনি কাশীতে যোগ ও তন্ত্র শিক্ষায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। সেই সময়ে তিনি “উড্ডীশতন্ত্র” নামে একটি গ্রন্থও রচনা করেন। পরবর্তীতে তিনি তার জমিদারির হারানো বাকি অংশ পুনরোদ্ধারের জন্য ইংল্যান্ডে না গিয়ে সেই উদ্দেশ্যে জমানো অর্থ দিয়ে একটি মন্দির স্থাপনের পরিকল্পনা নেন ও বাঁশবেড়িয়াতে ফিরে আসেন। তার প্রপিতামহের তৈরি টেরাকোটা মন্দিরের ক্ষয় দেখে পাথরের মন্দির নির্মাণের মনস্থ করেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি কাশীর কাছে চুনার নামে এক গ্রামে যান ও সেখান থেকে পাথর কিনে নদী পথে সেগুলিকে বাঁশবেড়িয়ায় নিয়ে আসেন। ১৭৯৯ তে মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। মন্দিরের দ্বিতীয় তল নির্মাণ হয়ে গেলে ১৮০২ তে সম্পূর্ণ মন্দির দেখার পূর্বেই তিনি মারা যান। ওনার জ্যৈষ্ঠ স্ত্রী ওনার সাথে সহমরণে যান। ওনার দ্বিতীয় স্ত্রী রানী শঙ্করী অসমাপ্ত মন্দির নির্মাণে ব্রতী হন। রাজস্থান থেকে আগত কারিগর দ্বারা প্রায় ১৫ বছরে এই মন্দির নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়। উত্তর রাজস্থানের শেখাওয়াতি স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই মন্দিরের নির্মাণে প্রায় ৫লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছিল। যা তদানীন্তন সময়ে টাকার মূল্যে ছিল বিশাল ব্যয়। মন্দিরের প্রতিষ্ঠা বর্ণনায় মন্দিরগাত্রে ব্যসল্ট পাথরের ফলকে সুন্দর বাংলা হরফে লেখা আছেঃ
“ শাকাব্দে রস বহ্নি মৈত্র গণিতে শ্রীমন্দিরং মন্দিরং ।
মোক্ষদ্বার চতুর্দ্দশেশ্বর সমং হংসেশ্বরী রাজিতং ।।
ভূপালেন নৃসিংহদেব কৃতিনারব্ধং তদাজ্ঞানুগা ।
তৎপত্নী গুরুপাদপদ্মনিরতা শ্রীশঙ্করী নির্ম্মমে ।।“    শকাব্দ ১৭৩৬

এর ভাবার্থ হল দেবী হংসেশ্বরী এই মন্দিরে চতুর্দ্দশ মোক্ষদ্বার রূপী মহাদেব এর সাথে বিরাজমান। নৃসিংহদেব ভূপাল এর তত্ত্বাবধানে ১৯৩৬ শকাব্দে এই মন্দির নির্মান সূচিত হয় ও তাঁর আজ্ঞানুগা পত্নী গুরুপাদপদ্মনিরতা শ্রীশঙ্করী এই নির্মান কাজ সমাধা করেন।
সংগৃহীত ছবি

সংগৃহীত ছবি




সংগৃহীত ছবি
নৃসিংহদেব নিজে তন্ত্রসাধক হবার ফলে তিনি এই মন্দিরটিও নির্মাণ করেন তন্ত্রকথা মাথায় রেখে। ১৩টি মিনার যুক্ত দক্ষিণমুখি পাঁচতলা এই মন্দিরের উচ্চতা ৭০ ফুট। এই ১৩টি মিনারের মধ্যে ৮টি মন্দিরের আট কোনে, মাঝখানে ৪টি ও কেন্দ্রস্থলে একটি বর্তমান।  কেন্দ্রীয় মিনারের ঠিক তলায় একটি প্রকোষ্ঠে রয়েছে একটি শিবলিঙ্গ। প্রতিটি মিনারের চূড়া পদ্মকুঁড়ির আদলে তৈরি। তন্ত্রসাধনার ষট্‌চক্রভেদ তত্ত্ব অনুসারে এই মন্দির নির্মিত হয়েছিল। তান্ত্রিক যোগসাধনা অনুযায়ী মানবদেহে সুষুম্নাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে ৫টি মুখ্য নাড়ী বর্তমান, যেগুলি হল ইড়া, পিঙ্গলা, বজ্রাক্ষ, সুষুম্না ও চিত্রিণী। তন্ত্রমতে সুষুম্নাকান্ডে ৬টি চক্র বর্তমান। এদের মধ্যে একেবারে তলদেশে রয়েছে মূলাধার চক্র যার মধ্যে রয়েছে সর্পিল ‘কুলকুণ্ডলিনী’। এই কুলকুণ্ডলিনীর একেবারে উপরে রয়েছেন মহাদেব শিব। তন্ত্র সাধনার এই তত্ত্বকেই মহারাজ নৃসিংহদেব মুন্দিরের স্থাপত্যের মধ্যে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। সেই আঙ্গিকে মন্দিরের গর্ভগৃহটি হল মূলধার চক্র সেখানে কুলকুণ্ডলিনী রুপে মা হংসেশ্বরী বিরাজিতা। এই গর্ভগৃহের ঠিক উপরেই রয়েছেন দেবাদিদেব মহাদেব। গর্ভগৃহের চারপাশে পাঁচটি সিঁড়ি রয়েছে যেগুলি দিয়ে মহাদের এর প্রকোষ্ঠে পৌঁছান যায়। মহাদেব যে প্রকোষ্ঠে রয়েছেন তার চারদিকে রয়েছে এক আশ্চর্য গোলকধাঁধা।
দ্বিতীয় তলে মহাদেব এর প্রকোষ্ঠের সামনে (সংগৃহীত ছবি)



পদ্মকুঁড়ি সদৃশ মিনার চূড়া (সংগৃহীত ছবি)

গর্ভগৃহের ঠিক কেন্দ্রে পঞ্চমুন্ডির আসনের ওপরে রয়েছে সহস্রদল নীলপদ্ম। তার ওপরে রয়েছে অষ্টদল পদ্ম। তার উপরে রয়েছে একটি ত্রিকোণাকার বেদী। এই বেদীর ওপরে শবাসনে রয়েছেন মহাকাল শিব। এই বেদী ও মহাকাল মূর্তি পাথর নির্মিত। মহাকালের হৃদয় থেকে বেরিয়ে আসা দ্বাদশদল পদ্মের উপর এক পা মুড়ে বসে আছেন দেবী হংসেশ্বরী। নিমকাঠের তৈরি চতুর্ভুজা মূর্তিটি নীল বর্নের। দেবীর উপরের বাম হাতে খড়গ ও নীচের বামহাতে নরমুন্ড রয়েছে। উপরের ডান হাতে বরাভয় মুদ্রা ও নীচের ডান হাতে শঙ্খ মুদ্রা বর্তমান। প্রতি বছর কালীপূজার দিন দেবীর বাৎসরিক পূজা হয়ে থাকে। ওই দিন দেবীর রুপের আমূল পরিবর্তন করা হয়। বছরের বাকি দিন গুলিতে আমরা দেবীর শান্ত মূর্তি দেখলেও কার্তিক অমাবস্যার রাতে দেবীকে রুপার মুখোশ ও সোনার জিভ পরানো হয়। গায়ে থাকে বহুমূল্যের স্বর্নালঙ্কার ও ফুলের মালা। বছরের অন্যান্য দিন দেবী দক্ষিণা কালী রুপে পূজিতা হন ও কালী পূজার দিন দেবী তন্ত্র মতে পূজিতা হন।




কার্ত্তিক অমাবস্যায় মায়ের মুখশ্রী (সংগৃহীত ছবি)
মন্দির সংলগ্ন রাজা নৃসিংহদেবের রাজবাড়ি এখনও বিরাজমান। যদিও তার জৌলুস বহু অংশে কমে গেছে। প্রধান রাজবাড়ির আশেপাশে প্রচুর ভগ্নাবশেষ এখনও বর্তমান।
প্রাচীন রাজবাড়ির ভগ্নাবশেষ

প্রাচীন রাজবাড়ির ভগ্নাবশেষ
মন্দির সকালে ৬টা থেকে ১২:৩০ অব্দি আবার বিকেলে ৪টে থেকে সন্ধ্যা ৭:৩০ অবধি সারা বছর খোলা থাকে। সকাল ১০টা অবধি অন্নভোগের কুপন দেওয়া হয়, মুল্য ৩৫ টাকা। হাওড়া থেকে যেকোনো কাটোয়া গামী ট্রেনে বাঁশবেড়িয়া নেমে অটো/ টোটো/ সাইকেল রিকশায় মন্দিরে পৌঁছানো যায়। কাটোয়ার ট্রেন না পেলেও অসুবিধা নেই। ব্যান্ডেল গামী যেকোনো ট্রেনে ব্যান্ডেল এ নেমে অটো বা মিনিবাসে বাঁশবেড়িয়া পৌঁছানো যায়। সড়ক পথে কল্যানী এক্সপ্রেস ধরে কল্যানী পৌঁছে সেখান থেকে গঙ্গার উপর ঈশ্বর গুপ্ত সেতু পেরলেই বাঁহাতে মন্দির যাবার রাস্তা পাওয়া যায়। সড়ক পথে দিল্লী রোড ধরেও বাঁশবেড়িয়া পৌঁছানো যায়। সেক্ষেত্রে দিল্লী রোড ধরে মগরা এসে সেখান থেকে ৬ নম্বর হাইওয়ে ধরে পৌছাতে হবে ঝুলনিয়া মোড় সেখান থেকে কল্যানী এক্সপ্রেস এর দিকে রাস্তা ধরে ঈশ্বর গুপ্ত সেতুতে ওঠার আগে ডানদিকে পরবে মন্দির যাবার রাস্তা।



তথ্য ঋণ ঃ www.hooghlyheritage.wordpress.com
                      www.indianvagabond.com

Saturday 13 June 2020

জীব-বৈচিত্র (Biodiversity) ও তার আঞ্চলিকতা


৫ই জুন, ছিল বিশ্ব পরিবেশ দিবস এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদযাপনের আয়োজক দেশ হল দক্ষিন আমেরিকার দেশ কলোম্বিয়া। আর এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের থিম বা মূল ভাবনা হল জীব-বৈচিত্র (Biodiversity)। এই জীববৈচিত্র এর ভৌগোলিক অবস্থান জনিত বিভিন্নতা একটি আশ্চর্যের বিষয়। জীব বৈচিত্র ও বাস্তুতন্ত্র একে অপরের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের বাস্তুতন্ত্র আছে। এই বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে যে যোগসূত্র রয়েছে সেটিই পৃথিবীকে বেঁচে থাকার রসদ জুগিয়ে চলেছে।

জীব বৈচিত্র কি ভাবে পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে?

আমরা জানি পৃথিবী তার অক্ষের ওপর ২৩.৫° হেলে ঘুরে চলেছে। এর ফলে সূর্য রস্মির পতনের হার পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে সমান হয়না। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে গ্রীষ্মকাল, শীতকাল ও অন্যান্য কালের ব্যাপ্তি আলাদা হয় যা ওই অঞ্চলের উষ্ণতা, আর্দ্রতা , ঠাণ্ডা প্রভৃতি আবহাওয়া সম্পর্কিত বিষয় গুলোকে প্রভাবিত করে। এই বিভিন্ন বিষয় গুলিই কোনও অঞ্চলের জীব-বৈচিত্র এর তারতম্যের ভৌগোলিক কারণ। বাস্তুতন্ত্রে জীববৈচিত্র্য হটস্পট (Biodiversity Hotspot) বলতে এমন একটি অঞ্চলকে বোঝায় যেখানে বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর ব্যতিক্রমী ঘনত্ব রয়েছে। এই হটস্পট গুলিতে বিশ্বের প্রায় ৬০% উদ্ভিদ, পাখি, স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ, উভচর বর্তমান। পৃথিবীর উপরিতলের বক্রতা এবং ঘূর্ণনের আরও একটি প্রভাব রয়েছে জল চক্রের ওপরে যা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে আলাদাভাবে জল বিতরণ করে। এর ফলেই পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টি ও তুষারপাতের তারতম্য ঘটে যা জীব-বৈচিত্র এর তারতম্যের আরও একটি অন্যতম ভৌগোলিক কারণ।

স্থলজ জীবাঞ্চল বা বায়োম

বায়োম (Biome) বা বাস্তুসংস্থানিক অঞ্চল হল একই রকম জলবায়ু, পরিবেশ, প্রানী ও উদ্ভিদ সম্বলিত অঞ্চল। এই এলাকা গুলিকে একই বাস্তুতন্ত্রে একত্রীভূত করে এক একটি জীবাঞ্চল হিসেবে ভাগ করেছেন। পৃথিবীতে প্রায় ১৫০ টি এইরকম জীবাঞ্চল বর্তমান, এর মধ্যে মূল চারটি হলঃ বনাঞ্চল, মরুভূমি অঞ্চল, তৃণভূমি ও সাভানা অঞ্চল এবং তুন্দ্রা অঞ্চল। 

বনাঞ্চল


বনাঞ্চল বা জঙ্গল বলতেই আমাদের চোখের সামনে যেটা ভেসে ওঠে সেটি হল সবুজ, ছোট, বড় বহু গাছের সমাবেশ। পৃথিবীর সমগ্র ভূভাগের প্রায় এক তৃতীয়াংশ বনভূমি দ্বারা অধিকৃত এবং পৃথিবীর সমগ্র সজীব উপাদানের প্রায় ৭০% কার্বন এই বনাঞ্চলের মধ্যে সংরক্ষিত রয়েছে। এছাড়াও জঙ্গল বা বনভূমির অন্যতম প্রধান উপযোগিতা হল এরা পৃথিবীর ফুস্ফুসের কাজ করে যা পৃথিবীর কার্বন ডাই অক্সাইড কে নিয়ে অক্সিজেন হিসেবে ফেরত দেয়। বনাঞ্চল মুলত তিন ধরনের হয়ে থাকেঃ ক্রান্তীয় বা গ্রীষ্মপ্রধান (Tropical), নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলিয় (Temperate), উত্তুরে (Boreal)
পৃথিবীতে যে কটি জীবাঞ্চল বর্তমান তার মধ্যে ক্রান্তীয় বনভূমিতে জীব বৈচিত্র সব থেকে বেশী। এই ক্রান্তীয় বনাঞ্চল বিষুব অঞ্চলের খুব কাছে হওয়ার কারনে দিনে কম বেশী প্রায় ১২ ঘণ্টা দিবালোকে থাকে। এখানে অন্যান্য জীবাঞ্চল অপেক্ষা অনেক বেশী বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। তাছাড়া এখানে গড় তাপমাত্রা কম বেশী ২০-২৫° সেন্টিগ্রেড এর মধ্যে থাকে মুলত এই তিনটি উপযোগী ভৌগলিক পরিবেশ থাকায় এখানে ঘন বনভূমি সৃষ্ঠির কারণ এই জীবাঞ্চলে অন্যতম প্রধান সমস্যা হল বন-নিধন বা Deforestation. এই অঞ্চলের অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদ টিক, মেহগিনি প্রভৃতি গাছ ঘরবাড়ি আসবাবপত্র তৈরির কাজে লাগে তাই যথেচ্ছাচারে এই সব গাছ কাটা হয় তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রে বনভূমি কেটে আঁখ, তাল প্রভৃতি গাছের চাষ করা হয় যেগুলি থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়া যায়।
Tropical Rainforest Landscape Stock Photo, Picture And Royalty ...
ক্রান্তীয় বনাঞ্চল (সংগৃহীত ছবি)
নাতিশীতোষ্ণ বনাঞ্চলে মুলত পর্ণমোচী গাছের সমাবেশ লক্ষ্য করা যায় যাদের শরৎকাল থেকে পাতা ঝরতে শুরু করে। ৩০°-৪৫° উত্তর অক্ষাংশ এবং ৩০°-৪৫° দক্ষিণ অক্ষাংশ এর মাঝে এই পর্ণমোচী বৃক্ষের জঙ্গল দেখা যায়। এই অক্ষাংশ অঞ্চলে সারা বছরে প্রায় ৭৫-১৫০ সেমি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। ক্রান্তীয় বনভূমির মত এই বনভূমি অঞ্চলেরও মূল বিপদ হল বন-নিধন।
Temperate Forests Are Mild-Climate Forests
নাতিশীতোষ্ণ বনাঞ্চল (সংগৃহীত ছবি)
Boreal বা উত্তুরে বনাঞ্চলের অন্যতম বিশেষত্ব হল সরলবর্গীয় শাঙ্কবাকার উদ্ভিদের উপস্থিতি। এই বনাঞ্চল তাইগা নামেও পরিচিত ৫০-৬০° উত্তর অক্ষাংশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এই বনাঞ্চল দেখা যায়। এই অঞ্চলের জলবায়ুর বিশেষত্ত্ব হল এখানে গ্রীষ্মকালের দৈর্ঘ্য অপেক্ষাকৃত কম ও তাপমাত্রার পারদ গরমকালে বিশেষ উর্ধ্মুখী হয়না। তবে শীতকালের ব্যাপ্তি অনেকটা ও বছরে প্রায় ৪০-১০০ সেমি এর মত তুষারপাত হয়ে থাকে। তবে বর্তমানে উষ্ণায়নের ফলে এশিয়া মহাদেশের রাশিয়া ও উত্তর আমেরিকার এই বনভূমি সংকট জনক পরিস্থিতির সামনে। তুষারপাতের পরিমান অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। ফলে এই বনভুমির মাটিতে তুষার আচ্ছাদনের সময় কাল কমে যাচ্ছে যা মাউন্টেন পাইন নামক এক ধরনের পোকার বংশ বিস্তারের অনুকুল পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। যা এই অঞ্চলের গাছপালা নষ্ট করছে এবং এই অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রের খাদ্যজালের (Food Webওপর বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে।
Mountain pine beetle | Natural Resources Canada
মাউন্টেন পাইন পোকা (সংগৃহীত ছবি)

Is there a difference between taiga and boreal forest? If not ...
উত্তুরে বনাঞ্চল (সংগৃহীত ছবি)
মরুভূমি
ভূপৃষ্ঠে যে সকল অঞ্চলে বাৎসরিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমান ৫০সেমি র কম সেই অঞ্চলে মরুভূমির সৃষ্টি হয়েছে। পৃথিবী পৃষ্ঠের পাঁচ ভাগের এক ভাগ হল মরুভূমি এবং এই অঞ্চল হল পৃথিবীর শুষ্কতম অঞ্চল যার ফলে এই অঞ্চলে জীব-বৈচিত্র সব থেকে কম। সাধারণত ৩০° উত্তর ও ৩০° দক্ষিণ অক্ষাংশ বরাবর মুরুভূমিগুলির অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। তবে অন্য অক্ষাংশেও মরুভুমি দেখা যায় তবে তাদের সৃষ্টির কারণ আলাদা। সুউচ্চ পর্বতমালার বিপরীত ঢালে বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলেও মরুভুমির সৃষ্টি হয়ে থাকে। সিয়েরা নেভেদা পর্বতের গ্রেট বেসিন মরুভুমি, আন্দিজ পর্বতের বিপরীত ঢালে প্যাটাগোনিয়ার মরুভুমি এই জাতীয় মরুভূমির উদাহরণ। দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকার দক্ষিণপশ্চিম সমুদ্রতট অঞ্চলে মরুভুমি দেখা যায়, যেগুলি যথাক্রমে আটাকামা মরুভুমি ও নামিব মরুভুমি নামে পরিচিত। এগুলি সৃষ্ট হবার কারণ আবার একটু আলাদা। এখানে গভীর শীতল সমুদ্রস্রোত সমুদ্র সংলগ্ন বায়ুমণ্ডলকে শীতল করে তোলে। ফলে এই বায়ু ভূভাগে আসার পূর্বেই তার সমস্ত আর্দ্রতা বৃষ্টি রুপে সমুদ্রপৃষ্ঠে ঝরিয়ে দেয়। আবার মেরু অঞ্চলিয় মরুভূমি মুলত সুমেরু ও কুমেরু অঞ্চলে দেখা যায়উত্তর গ্রিনল্যান্ড ও আন্টারটিকার বরফ বিহীন অঞ্চলে এই ধরনের মেরু মরুভূমি দেখা যায়।
Desert Basin | Near Agua Fria and Alamo de Cesario creeks. I… | Flickr
গ্রেট বেসিন মরুভুমি (সংগৃহীত ছবি)Where Does The Patagonian Desert Lie? - WorldAtlas
প্যাটাগোনিয়ার মরুভুমি (সংগৃহীত ছবি)What's So Special About the Atacama Desert? | Live Science
আটাকামা মরুভুমি (সংগৃহীত ছবি)Where the Namib Desert Meets the Atlantic Ocean, Namibia Robert ...

নামিব মরুভুমি (সংগৃহীত ছবি)

প্রত্যেক মরু অঞ্চলেই তার বিশেষ কিছু উদ্ভিদ, মেরুদণ্ডী ও অমেরুদণ্ডী প্রাণী লক্ষ্য করা যায় যারা নিজেদের ওই প্রতিকূল পরিবেশে অভিযোজিত করার জন্য শারীরিক গঠনের বিশেষ কিছু পরিবর্তন ঘটায়। যেমন মরু অঞ্চলিয় উদ্ভিদের অন্যতম বৈশিষ্ঠ্য হল বাষ্পমোচন হ্রাস করার জন্য এই উদ্ভিদের পাতা কণ্টকে রুপান্তরিত হয়। আবার উত্তর আমেরিকার দক্ষিণ-পশ্চিমের সোনোরান মরুভূমিতে এক ধরনের শিয়াল দেখা যায় যাদের কানের বাইরের অংশ অনেক প্রসারিত যার থেকে জল বাষ্পীভূত হয়ে দেহকে ঠাণ্ডা রাখে।
Kit fox , vulnerable species. Sonoran Desert, Arizona, USA. News ...
সোনোরান মরুভূমির কিট শেয়াল (সংগৃহীত ছবি)Some of the 55,000 desert plants to be found at the Desert ...
মরুভূমি অঞ্চলের গাছপালা (সংগৃহীত ছবি)

সাভানা ও তৃণভূমি অঞ্চল
সাভানা ও তৃণভূমি অঞ্চলের বৈশিষ্ঠ্য হল বহু বর্ষজীবী ঘাস ও কাষ্ঠ বিহীন গাছ গাছড়ার উপস্থিতি যদিও সাভানা অঞ্চলে বাৎসরিক পর্যাপ্ত পরিমানে বৃষ্টিপাত হয় তাই কিছু ছড়ানো ছিটানো বড় গাছ ও এই অঞ্চলে দেখা যায় কিন্তু তৃণভূমিতে এই বৃষ্টিপাতের পরিমান পর্যাপ্ত নয় তৃণভূমি মুলত নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার অন্তর্গত হওয়ায় গ্রীষ্মকালে যেমন গরম পরে শীতকালেও তেমন তুষারপাত ঘটে এই সকল উদ্ভিজ্জ বৈশিষ্ঠ্যর জন্য এই অঞ্চলে তৃণভোজী প্রাণীর উপস্থিতি চোখে পরার মত যেমন আফ্রিকার সভানা অঞ্চলে ওয়াইল্ড বিস্ট হরিণ বা উত্তর আমেরিকার সমভূমি অঞ্চলে বাইসন এই জীবঞ্চলের বৈশিষ্ঠ্য আফ্রিকার এই ওয়াইল্ড বিস্ট, জেব্রা বা গ্যাজেল এর মত তৃণভোজী প্রাণীরা বছরের একটা সময়ে সাভানার এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে পাড়ি দেয় আর্দ্রতার জন্য কিন্তু ক্রমবর্ধমান নগরায়নের ফলে এদের গতিপথ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে যার ফলে এদের পরিবেশগত অবস্থান (Ecological Niche) ক্ষতির সন্মুখিন হচ্ছে সাভানা অঞ্চলের ঘাসের আর একটা উল্লেখ্য বৈশিষ্ঠ্য হল এদের শিকড় অনেক দীর্ঘ হয় আর এরা তাড়াতাড়ি বেড়ে ওঠে তাই এই অঞ্চলের মাটি জৈব কার্বনের ভাণ্ডার হিসেবে কাজ করে। পৃথিবীর এই রকম অধিকাংশ তৃণভূমি পরবর্তীকালে চাষের জমিতে পরিণত করা হয়েছে যার ফলে সেখানকার মাটির জৈবনিক গুনাগুন নষ্ট হয়েছে ও ওই অঞ্চলের জীব বৈচিত্র হ্রাস পেয়েছে।
পৃথিবীর প্রধান প্রধান তৃণভূমি | দেখে ...
সাভানা ও তৃণভূমি অঞ্চল (সংগৃহীত ছবি)
তুন্দ্রা অঞ্চল
তুন্দ্রা হল পৃথিবীতে শীতলতম জীবাঞ্চল যেখানে শীতকালীন গড় তাপমাত্রা -৩৪° সেন্টিগ্রেড ও গ্রীষ্মকালীন গড় তাপমাত্রা ৩-১২° সেন্টিগ্রেডের মধ্যে থাকে। এখানে গ্রীষ্মকাল ৫০-৬০ দিনের মত স্থায়ী হয়। এই স্বল্প সময়েই এখানে দলে দলে পরিযায়ী পাখি ও বল্গা হরিণের উপস্থিতি চোখে পরে। এই অঞ্চলের মাটিও জৈব খনিজে ভরপুর যা সব সময়ে হিমায়িত (Frozen) অবস্থায় থাকে। একে পারমাফ্রস্ট (Permafrost) বলে। তবে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই পারমাফ্রস্ট এর স্তর ক্রমশ গলতে শুরু করেছে ফলে বিভিন্ন জৈবিক উপাদান সমূহ পরিবেশে নির্গত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে মিথেন, যা এইভাবে পরিবেশে নির্গত হয়ে গ্রীন হাউস এফেক্ট এর সৃষ্টি করছে।
Tundra Region - Climate, Animals, Human Life, Vegetation
তুন্দ্রা অঞ্চল (সংগৃহীত ছবি)

জলজ বাস্তুতন্ত্র


জীবমণ্ডলের সমগ্র অঞ্চলের মধ্যে জল সবচেয়ে বেশী অঞ্চল অধিকার করে আছে। এই জলই হল বিভিন্ন জলজ বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী উপাদান। জলজ বাস্তুতন্ত্রের জীব বৈচিত্র সবচেয়ে বেশী এই জলজ বাস্তুতন্ত্র মুলত দুই প্রকারের হয়ঃ পরিষ্কার স্বাদু জলের বাস্তুতন্ত্র লবনাক্ত বা সামুদ্রিক জলের বাস্তুতন্ত্র।

পরিষ্কার স্বাদু জলের বাস্তুতন্ত্র
স্বাদু জলের বাস্তুতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ঠ্য হল এতে লবনের ভাগ খুবই কম থাকে। মুলত নদনদী, ভূগর্ভস্থ জল, পুকুর, হ্রদ, খাল, বিলে এই ধরনের বাস্তুতন্ত্র দেখা যায়। তবে প্রবহমান জলের বাস্তুতন্ত্র যা লোটিক সিস্টেম (Lotic System) নামে পরিচিত তার জীব বৈশিষ্ঠ্য, স্থির জলের বাস্তুতন্ত্র যা লেন্টিক সিস্টেম (Lentic System) নামে পরিচিত, তার জিব-বৈশিষ্ঠ্য অপেক্ষা আলাদা
বিভিন্ন অক্ষাংশে জলবায়ুর বিভিন্নতার দরুন ভৌগোলিক কারনে স্বাদু জলের বাস্তুতন্ত্রে জিব-বৈচিত্রের বিভিন্নতা দেখা যায়। বিষুবাঞ্চলীয় স্থলজ জীবমণ্ডলের মতই বিষুবাঞ্চলীয় জলজ জীবমণ্ডলে বিভিন্ন প্রজাতির জীব লক্ষ্য করা যায়। মাছ ও উভচরের ক্ষেত্রে এই বৈচিত্র সর্বাধিক। এই জীব বৈচিত্র বিষুব অঞ্চল থেকে যত উত্তর বা দক্ষিণ অক্ষাংশ বরাবর যাওয়া যায় ততই কমতে থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় আমাজন নদীর কথা। এই নদীতে ২০০০ থেকে ৫০০০ এর বেশী প্রজাতির মাছ আছে ও এই নদী বিষুব অঞ্চল বরাবর প্রবাহিত হয়েছে। ওপর দিকে মিসিসিপি নদী, উত্তরে ৪৫°-৩০° অক্ষাংশ বরাবর বয়ে চলেছে, তাতে সর্বাধিক ৩৭৫ রকমের প্রজাতির মাছ বর্তমান সন্মিলিতভাবে কমবেশি প্রায় ১৫০০০ রকম মাছের প্রজাতির মধ্যে প্রায় ৪৫% হয় স্বাদু জল বা স্বাদু ও লবন মিশ্রিত ব্র্যাকিশ জলে (Brackish Water) পাওয়া যায় বাকি ৫৫% মাছের প্রজাতি সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের অধিবাসী আণুবীক্ষণিক শেওলা বা মাইক্রো অ্যালগি হল বেশীরভাগ জলজ বাস্তুতন্ত্রের উৎপাদক শ্রেণির অন্তর্গত তাই খাদ্য শৃঙ্খলের একেবারে তলায় এদের অবস্থান
সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র
ভূভাগের উপরিতল ক্ষয় হয়ে ক্ষয়িত লবন সমুদ্রের জলের লবনাক্ততাকে বৃদ্ধি করে ভূভাগের চারভাগের প্রায় তিন ভাগ সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের অধীন। সাগর, মহাসাগর ছাড়াও প্রবাল প্রাচীর, সামুদ্রিক খাঁড়ি ও এই বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে পরে। এদের মধ্যে সামুদ্রিক খাঁড়ি হল সমুদ্র ও নদীর সংযোগস্থল। তাই এতে সামুদ্রিক লবনাক্ত জলের সাথে স্বাদু জলও মিশ্রিত থাকে। একে ব্রাকিশ জল (Brackish Water) বলে। সমুদ্রের উদ্ভিদ প্ল্যাঙ্কটন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলীয় অক্সিজেনের উৎস হিসেবে কাজ করে পরিবর্তে এই উদ্ভিদ প্ল্যাঙ্কটন বায়ুমণ্ডল হতে অধিকাংশ কার্বনডাইঅক্সাইড কে গ্রহন করে।
সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রকেও স্থলজ জীবাঞ্চলের মত বিভিন্ন বাস্তু অঞ্চলে ভাগ করা যায়।
সামুদ্রিক খাঁড়ি বা Estuaries
নদী যখন সমুদ্রে মিলিত হয় তখন সেই মিলনস্থলকে বলে খাঁড়ি। স্বাভাবিক ভাবে নদী ও সমুদ্রের জলের লবণ ও বিভিন্ন পোষক পদার্থের ঘনত্ব আলাদা হয়। ফলে এই দুটি সম্পূর্ণ আলাদা জলীয় বাস্তুতন্ত্রের মিলনস্থলকে বলে ইকোটোন (Ecotone) এবং এই ইকোটোন অঞ্চল জীববৈচিত্রে সমৃদ্ধ হয়ে থাকে। উদ্ভিদদের মধ্যে মাইক্রোফ্লোরা যেমন শেওলা, ম্যাক্রোফ্লোরা যেমন সামুদ্রিক শৈবাল, লবনাম্বুজ (Mangrove) উদ্ভিদ (কেবলমাত্র বিষুব অঞ্চলে) খাঁড়িতে পাওয়া যায়। আর প্রানীদের মধ্যে বিভিন্ন প্রকারের সামুদ্রিক কীট, কাঁকড়া, ঝিনুক ইত্যাদি প্রধান।

Estuaries | NIWA
সামুদ্রিক খাঁড়ি (সংগৃহীত ছবি)

ইন্টার টাইডাল ও সাব টাইডাল অঞ্চল
সমুদ্রতটবর্তী অঞ্চল যা নদীর মোহনার থেকে দূরবর্তী সেই অঞ্চল সমূহ ইন্টার ও সাব টাইডাল অঞ্চলের অন্তর্গত। ইন্টার টাইডাল অঞ্চল পর্যায়ক্রমে জোয়ারের সময় জলাচ্ছন্ন থাকে আর ভাটার সময় বায়ুতে উন্মুক্ত হয়। এই বাস্তুতন্ত্রের জীবেরা পর্যায়ক্রমিক উন্মুক্ত বায়ু ও জলাচ্ছন পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারে। মুলত ঝিনুক, তারামাছ, সামুদ্রিক অ্যানিমোন, শৈবাল এই প্রকার বাস্তুতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত। সাবটাইডাল অঞ্চল সমুদ্রতট থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত যা সব সময়েই জলের তলায় থাকে ও জোয়ারের জল দ্বারা প্রভাবিত হয়। ঘন শেওলা ও সামুদ্রিক ঘাসের স্তর এই ধরনের বাস্তুতন্ত্রে দেখা যায় যা বিভিন্ন মাছ, চিংড়ী ও অন্যান্য সামুদ্রিক জীবের বাসস্থান।
প্রবাল স্তর অঞ্চল
পৃথিবীতে সর্বাপেক্ষা বৈচিত্রময় বাস্তুতন্ত্র এই প্রবালস্তরে অবস্থিত। এই স্তর বিভিন্ন মহাদেশের মাঝে প্রাচীর হিসেবে অবস্থিত। প্রবাল মুলত জুজ্যানথেলি (Zooxanthellae) প্রাণীজ পলিপ (Polyps) এর মাঝে এক প্রকার অন্যোন্যজীবি (Symbiosis) সম্পর্ক। এক্ষেত্রে উভয়ে ক্যালসিয়াম কার্বোনেট বা চুনাপাথর নির্মিত একটি কঠিন কাঠামোর মধ্যে থাকে। এই সুন্দর কাঠামো বিভিন্ন মাছের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ক্রান্তীয় দেশ গুলির ক্ষেত্রে এই প্রবাল প্রাচীর ও সংলগ্ন সামুদ্রিক ঘাসের স্তর ও লবনাম্বুজ উদ্ভিদ গোষ্ঠী অর্থনৈতিক ও বাস্তুসংস্থানগত দিক থেকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীতে সর্বোচ্চ জীব বৈচিত্র সমৃদ্ধ সামুদ্রিক জীবাঞ্চল কোরাল ত্রিভুজ নামে পরিচিত। কোরাল ত্রিভুজের অন্তর্গত বিভিন্ন অঞ্চল গুলি হলঃ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু অংশ, প্রশান্ত মহাসাগরের বিভিন্ন অঞ্চল যেমন ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, পাপুয়া নিউগিনি, ফিলিপাইন্স, টিমোর লেস ও সলোমন দ্বীপপুঞ্জ। এই কোরাল ত্রিভুজ অঞ্চলে বিশ্বের সর্বাধিক প্রবাল ও সর্বাধিক প্রজাতির মাছের উপস্থিতি লক্ষ্যনীয়। ৭৮৯ প্রকার কোরাল প্রজাতির মধ্যে প্রায় ৭৬% ও ৬০০০ কোরাল মাছ প্রজাতির মধ্যে ৩৭% এই অঞ্চলে পাওয়া যায়।
Coral Reef Bleaching & Rising Sea Temperatures
প্রবাল স্তর (সংগৃহীত ছবি)

সামুদ্রিক অঞ্চল বা
Pelagic Zone
সমুদ্রতট থেকে বহু দূরে উন্মুক্ত জল এই অঞ্চলে অন্তর্গত। সমুদ্রের উপরিভাগ থেকে সমুদ্র গভীরে যত দূর আলো পৌছায়, ততদূর অবধি এই অঞ্চল বিস্তৃত। এই অঞ্চলে যে সকল জীব দেখা যায় তারা সকলেই প্ল্যাঙ্কটনের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে। তাই এদের প্ল্যাঙ্কটিভোরাস বলা হয়। এদের উদাহরণ হল স্মেল্ট, সার্ডিন , স্যামন, তুনা, সোডফিস, সানফিস ইত্যাদি।
ইলিশের মত দেখতে নকল ইলিশ বা সার্ডিন ...
সার্ডিন (সংগৃহীত ছবি)This 5,000-Pound Behemoth Is the World's Heaviest Bony Fish | Live ...

সানফিস (সংগৃহীত ছবি)
 অ্যাবিসাল অঞ্চল (Abyssal Zone)
পেলাজিক অঞ্চলের পর থেকে গভীর সমুদ্রতলে যেখানে আলো পৌছায়না, সেই অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত। যেহেতু এখানে আলো পৌছায় না তাই এখানে স্বালোকসংশ্লেষকারী জীব এখানে থাকে না। তা স্বত্বেও এই অঞ্চলে বিভিন্ন বৈচিত্র যুক্ত জীব এখানে থাকে। এই অঞ্চলে উপস্থিত একটি উল্লেখযোগ্য প্রাণী হল অ্যাংলার মাছ।এদের দেহ হতে এক ধরনের ফ্লুরোসেন্ট আলো নির্গত হয় যা এদের শিকারকে আকর্ষণ করে কাছে টেনে আনে।
সাগরের বিস্ময়কর মাছ এংলার ফিশ
অ্যাংলার মাছ (সংগৃহীত ছবি)




তথ্যসূত্রঃ https://healingearth.ijep.net/